ওয়াহিদুল হক প্রয়াত হয়েছেন আট বছর হতে চলল। জানুয়ারি মাসের ২৭ তারিখে তাঁর প্রয়াণ দিবস। অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয় যে, জীবিতকালে ২৭ সংখ্যাটিকে ওয়াহিদুল হক খুব পছন্দ করতেন, বয়স গণনায় তিনি আনন্দের সঙ্গে বলতেন যে, বয়সটাকে ‘আমি ২৭ এ রাখতে চাই’। আরও বলতেন ‘একজন মানুষের সেরা বয়সকাল হওয়া উচিৎ ২৭’। দেশের মানুষ, সংস্কৃতিমান সকল মানুষ ‘ওয়াহিদ ভাই’ বলেই তাঁকে জানতেন এবং তাই মানতেন। আমরাও তাই জেনেছি, বয়সের অনেক ফারাক সত্ত্বেও আমরাও যাতে করে ‘ওয়াহিদ ভাই’ বলেই ডাকতে পারি সেই স্নেহাশিস তিনি আমাদের দিয়েছিলেন। ওয়াহিদ ভাইয়ের ভাষ্য— মাঝে-মধ্যে দু-একজনকে পাওয়া যায় যাঁরা তাঁকে স্যার বলে ডাকতেন তখনি তিনি নিশ্চিত হন যে, এ ছেলে কণ্ঠশীলনের। বেশ কিছুদিন আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন উর্দ্ধতন কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলী কণ্ঠশীলন আবর্তন সম্পন্ন করেন এবং সংগঠনের সাথে যুক্ত হন। এই আলী ভাই ওয়াহিদ ভাইকে স্যার বলতেন। মাঝে-মধ্যে আমরা আলী ভাইকে বলবার চেষ্টা করেছিলাম স্যারের পরিবর্তে ভাই ডাকলে ওয়াহিদ ভাই হয়তো বেশি খুশি হবেন। আলী ভাই এর কথা হচ্ছে ‘আমার বড় ভাই এতো জানেন না, অতএব আমি তাঁকে ভাই ভাবতে পারি না’।
এক বছর, দুই বছর নয় কণ্ঠশীলন সূত্রে বিরতিহীনভাবে ২৩ বছর ওয়াহিদ ভাইয়ের সঙ্গে কাজ করতে পেরেছি, তাঁর ছায়া পেয়েছি, যেন বাঙালি-সংস্কৃতির অপরূপ সান্নিধ্যে অন্তরঙ্গ হতে প্রয়াস পেয়েছি। আজ তিনি বহুদূরে, জগতের যত হাসি-কান্না, হিসাব-নিকাশের বাইরে। আবার বহুকাছেও আছেন তিনি, তাঁর কর্মে, তাঁর সৃষ্টির পথে পথে, অন্তরের অনুরণনে … কথাহীন, শরীরহীন অনন্ত হয়ে। দিন চলে যায়, চলে যাবে। তবে তাঁর ছোঁয়াটুকু, কর্মটুকু থাকবে, থাকতেই হয়, যেমনটি করে সক্রেটিস, লালন বেঁচে আছেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। প্রয়াত নাজিম মামুদ ওয়াহিদ ভাইকে বলতেন ‘হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা’। ঠিক তাই। বাঁশির সুর ছড়িয়েছিলেন তিনি পথে পথে, পদে-পদে জাতিসত্ত্বার ‘চির উন্নত শিরে’ অবগাহনে। সেই সুর তাঁকে চিনিয়ে দেবে কালে কালে। অবিশ্বাস্য তাঁর পথচলাসীমানা, পদচিহ্নিতসীমা, অবিশ্বাস্য তাঁর পরিচিতজন-স্বজন পরিধি বয়সের গণনাকে তুচ্ছ করে।
ওয়াহিদ ভাই মারা যাওয়ার পর ঐ বছরেই তাঁর জ্যেষ্ঠ সন্তান অধ্যাপক অপালা ফরহত নবেদ কেরাণীগঞ্জের আটি ভাওয়ালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘ওয়াহিদুল হক কর্মপরম্পরা’ নামের একটি সংগঠন। বর্তমানে সংগঠনটির নাম ‘কল্যাণপরম্পরা’। তারানগরের আটি ভাওয়াল বিদ্যালয়কে তিনি নির্ধারণ করলেন তাঁর কাজের জায়গা হিসাবে। নগর জীবনের নানামুখী কর্মের ব্যস্ততাকে ডিঙিয়ে হ্যাঁচকা টানে, নিজেকে নিয়ে এলেন গ্রামে, পিতামহের মাটিতে, ওয়াহিদুল হকের পিতৃভূমিতে। ‘ওয়াহিদুল হক কর্মপরম্পরা’র অনেকগুলো শাখা করে অপালা অতি দ্রুত নানামুখী কাজের বিস্তার ঘটালেন সেখানে। ঢাকার মানুষ ছাড়াও জড়ো করলেন স্থানীয় নবীন-প্রবীণ অনেককে। অল্পকিছুদিনের মধ্যে কী আশ্চর্য এক জাদুবলে অপালা মন জয় করে নিলেন সেই উদ্দিপ্ত নবীন-প্রবীণ সকলের। নুর উদ্দিন আহমেদ, শাহাব উদ্দিন আহম্মেদ, মাহমুদুল হক, খলিলুর রহমান, মোশারফ হোসেন ফারুক, ওয়াছি উদ্দিন, বুলবুল ইসলাম, বায়েজীদ হোসেন, আক্তার হোসেন মিটু, আফরোজা আক্তারসহ নগরীর নীরু শামসুন্নাহার, নগরবাসী বর্মণ, নরোত্তম হালদার ও জাকারিয়াসহ আরো অনেককে অন্য এক মমতামীয়র ভালোবাসায় বেঁধে ফেলেছিলেন অপালা। গ্রামে সকলের কাছে অপালা এক ডাকে হয়ে উঠলেন আপা, সকলের অত্যন্ত নিকটজন হয়ে।
অপালা তাঁর যোগ্যতা দিয়ে, অমানুষিক শ্রম দিয়ে ওয়াহিদুল হকের বিস্তৃত কর্মের ব্যাপক-ভাবনা বিন্যাসের খানিকটাও জাগিয়ে রাখতে, ছড়িয়ে দিতে ব্রত নিয়েছিলেন পিতৃভূমির মাটি থেকেই। সেই অপালাও আজ নেই। ব্রত বাঁচল তিনি বাঁচলেন না। সংগঠনটি চলছে নিয়মিতভাবে নানা আয়োজন নিয়ে যার সূত্রপাত সুকন্যা অপালাকে দিয়ে। প্রিয় পিতার ডাক নাম ‘সরোজ’ নিয়ে ‘সরোজ’ সংস্কৃতিবৃত্তের পরিচালনায় এই প্রতিষ্ঠানে সঙ্গীত, আবৃত্তি, আঁকা-গড়া, ব্রতচারী ও শুদ্ধ উচ্চারণ নিয়ে এই সংস্কৃতিবৃত্তের কাজ শুরু হয়। স্থানীয় শিশু-কিশোরদের কোলাহলে মুখরিত হয়ে ওঠে এখন এই প্রতিষ্ঠান প্রাঙ্গণ।
এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত একজন কর্মী হিসাবে নিজের মধ্যে ভাবনা তৈরি হয়, অপালা কেন গ্রামে পিতৃভূমিতে ছুটেছিলেন নগরের নানা আয়োজন-মঞ্চায়নকে ছেড়ে দিয়ে এবং কী করতে চেয়েছিলেন পিতামহের ভূমি, মনোহরিয়ায়? এই সংগঠনের সদস্যদের নানা সময়ের কথোপকথন থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার হয় যে, অপালা সত্যিকার অর্থে একটি আদর্শ বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন। ধীরে ধীরে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন নতুন প্রজন্মের কাছে, দেশের প্রান্তে-প্রান্তে। গৌতম বুদ্ধের মতো করে … ‘বুদ্ধং শরনং গচ্ছামিন, ধর্মং শরনং গচ্ছামিন, সংঘং শরনং গচ্ছামিন’। সেই আদর্শ হলো ওয়াহিদুল হক আদর্শ, তাঁর কর্মের আদর্শ ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’ এই আদর্শ। সে আদর্শ প্রতিষ্ঠায় সংঘ চাই, সংঘের মধ্যে সেই শক্তি নিহিত। ওয়াহিদ ভাই সারাজীবন ‘সংঘং সরণং’-কে মেনেছেন এবং সেইমত কাজ করেছেন। নগরে-গ্রামে, জেলায়, উপজেলায় দেশের আনাচে-কানাচে সংঘ তৈরিকে অনুপ্রেরণা দিয়েছেন, সাথে থেকেছেন, সংঘে সকলকে আনার ব্যবস্থা করেছেন। বিস্তৃত বাংলার প্রান্তরজুড়ে ব্যক্তিক সম্পর্কের এক বীজ রোপন করেছেন নিজকর্ম-শ্রম দিয়ে, সকল কর্মপ্রয়াসী বান্ধবদেরকে নিয়ে। এই বীজ একদিন গাছ হবে, ফল দেবে নিশ্চয় জেনে। অপালা চেয়েছিলেন ওয়াহিদুল হকের মৃত্যুর পর সেই বীজ রোপনের কাজটি অন্যভাবে নতুন করে শুরু হোক, আর তা শুরু হোক ওয়াহিদুল হকের পিতৃভূমি থেকে। অনেকের দুঃখবোধ আছে বিশেষ করে ওয়াহিদ ভাই এর গ্রামের মানুষের, আরেকটু সময় তিনি যদি দিতেন তাঁর গ্রামকে। প্রিয় মানুষের কাছে প্রত্যাশার পরিমাণও বেশি হয়। তবে কাজী নজরুল ইসলামের সেই পঙ্ক্তিটি এখানে উল্লেখ করা যায় যে, ‘আমি যে কূলে, যে সমাজে, যে দেশেই জন্মগ্রহণ করি না কেন সে আমার দৈব, তাকে ছাড়িয়ে উঠতে পেরেছি বলেই আমি কবি, বনের পাখি নীড়ের উর্দ্ধে উঠে গান করে বলে বন তাকে কখনও অনুযোগ করে না …’।
ওয়াহিদ ভাই-এর সঙ্গে কণ্ঠশীলনের শেষ বসা হয়েছিল এক শুক্রবারে, কণ্ঠশীলনের সাপ্তাহিক সম্মিলনের দিনে। সামনে ছিল ১৬ই ডিসেম্বর, বিজয় দিবস এবং ঈদের ছুটি। সেই ঈদের ছুটিতে ওয়াহিদ ভাই তালতলার বাসাতেই ছিলেন। সেখান থেকেই অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন, সেই হাসপাতাল থেকে তাঁর মরদেহ ফিরেছে, ফিরেছে বলতে বারডেম থেকে বেরিয়ে পিজি হাসপাতালে ঢুকেছে। কারণ দেহ আগেই দান করা ছিল পিজি হাসপাতালকে। ওয়াহিদ ভাই-এর ফুসফুসে পানি জমেছিল। বের করাও হয়েছিল। তিনি অনেক সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন। দুর্বল ছিলেন বসতে পারতেন না। দীপা ধরাধরি করে খানিকটা বাঁকা করে বসানোর চেষ্টা করত। তখন ছিল ওয়ান ইলেভেন মুহূর্ত। ডাক্তারের পরামর্শে সব কথা তাঁকে বলাও হতো না। এরই মধ্যে তিনি জিজ্ঞাসা করে বসতেন কে কেমন আছেন। দেশের খবর কী জানতে চান! দেশ-মানুষ-ভাষা তাঁর কাছে সবার আগে। দেশের মানুষও জানতে চান ওয়াহিদ ভাই-এর খবর, কেমন আছেন। দেখতে চান এক নজর ডাক্তারি নজরদারি টপকেও। ওয়াহিদ ভাই-এর সঙ্গে সম্পর্কিত সকলের একটা বদ্ধমূল ধারণা কিংবা সকলে বিশ্বাস করে ওয়াহিদ ভাই-এর সঙ্গে তারই কেবল আলাদা এবং অথচ গভীর একটি আত্মিক সম্পর্ক আছে এমনটা আর কারও সঙ্গে নেই। আমরা বিশ্বাস করি, এই আত্মীয়তা নিয়ে ওয়াহিদ ভাই বেঁচে থাকবেন অনেকদিন। কবি ও প্রাবন্ধিক আবুল মোমেনের এক লেখায় যেমনটি পাই … ‘বাংলাদেশ জুড়ে তাঁর ঘর আছে, সে ঘর খুঁজে মরতেও হয় না তাকে। যেখানে যান সামান্য আনুকূল্যেই প্রাণবীজ গজিয়ে ওঠে, তাঁকে ঘিরে তাঁর কাছ থেকে পেয়ে হঠাৎই নিষ্প্রাণ রুক্ষ জমিনে দাপিয়ে ওঠে প্রাণ-সতেজ প্রফুল্ল’।
১৯৯৬ সালে ওয়াহিদ ভাই-এর জীবদ্দশাতেই সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক বন্ধুকে কবিতা দিয়ে জানালেন ভালোবাসা …
বান্ধব ওয়াহিদুল হকের প্রতি
মৃত্যু নয় ঘুম, আর ঘুম মৃত্যু নয় –
এই স্পষ্ট বিভাজন বাঙালি ভুলেছে
শ্মশানের দিকে তারা দরোজা খুলেছে;
রবীন্দ্রনাথের কীর্তি তবে কিছু নয়?
দেহ থেকে খসে পড়া বিখ্যাত সে জামা
এখন বদ্বীপে দেখি পলিতে গড়ায়-
নৌকোর গলুই ঠেকে গিয়েছে চড়ায়;
এখন তো একই কথা- চলা কিম্বা আসা।
তারই মধ্যে সখা তুমি নাতিদীর্ঘ দেহ
দিগন্ত অবধি ছোঁয়া ছায়া সহকারে
ধীরে এসে দাঁড়িয়েছো উৎসন্ন সংসারে-
তোমার কণ্ঠে কী বর্ষা খর বৈশাখেও!
তবু কি মরুভূমি হয়েছে উষর?
ঘোর কলেরার করা দেবে না উত্তর?